কৃষি খাত ও জলবায়ু পরিবর্তন
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত মিলিয়ে ছয়ঋতুর প্রকৃতি শুধুমাত্র বইয়ের পৃষ্ঠাতেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে এর দেখা মেলে না। বাস্তবতার অমোঘ নিষ্ঠুরতা হচ্ছে, প্রতি দুই মাসের চক্রে ঋতুর আর অস্তিত্ব নেই। আর এর জন্য দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন। কোনো একটি জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার গড়পড়তা ধরনকে বলা হয় জলবায়ু। আবহাওয়ার সেই চেনাজানা ধরন বদলে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে- বন্যা, খরা, ঝড়, পানির সঙ্কট, দাবানল, খাদ্য উৎপাদনে অস্থিরতা, সমুদ্রের পানি বেড়ে বহু এলাকা তলিয়ে যাওয়া। এক মৌসুমে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে তো, আরেক মৌসুমে সর্বনাশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হিসেবে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকে ধরা হয়; যার কারণে কয়েক দশক ধরে বৈশ্বিক উষ্ণতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের গুটিকয়েক দেশ তথা শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো অধিক হারে কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী, কিন্তু এর প্রভাব পড়ছে বিশ্বের প্রতিটি দেশে। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে কার্বন নিঃসরণের হার কমানো ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ হ্রাস করার কথা থাকলেও কোনো দেশই এখন পর্যন্ত এই বিষয়গুলো তেমন গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়নি। এতে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চ ঝুঁঁকিতে রয়েছে। ছোট আয়তন, বিপুল জনসংখ্যা ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতায় হওয়ায় এ দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁঁকি অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেকাংশে বেশি।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দেশে ধানের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ধান চাষের ক্ষেত্রে ১৮-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। শীতের সময় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রির অনেক নিচে নেমে যায় এবং গরমের সময় ৩৫ ডিগ্রির ওপরে উঠে যায়। এতে ধানের পরাগায়নে অনেক সমস্যা হয় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলার কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমির মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতেও ফসল উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। গবেষকদের মতে, এভাবে যদি কৃষিজমির লবণাক্ততা বাড়তে থাকে তা হলে কৃষি আয় বছরে ২১ শতাংশ কমে যাবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি হুমকির মুখে পড়বে। এতে দুই লাখ ৪০ হাজার কৃষকের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ধান ছাড়া দেশে এখন অন্যান্য শস্য যেমন- পাট, গম, ভুট্টা, মটর, ছোলা উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে শিলাবৃষ্টি, ঝড়, আকস্মিক বন্যা প্রভৃতি। এতে তাদের মাথাপিছু আয় হ্রাস পাচ্ছে। রবি মৌসুমে অতিরিক্ত শৈত্যপ্রবাহ থাকায়ও ফসল উৎপাদন অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরেকটি বড় খাত হচ্ছে মৎস্য খাত। তথ্য অনুযায়ী, এ দেশে প্রায় এক লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর পুকুর, পাঁচ হাজার ৪৮৮ হেক্টর বাঁওড় এবং ১১ কোটি হেক্টর চিংড়িঘেরে মাছ চাষ হয়। এ ছাড়া ৪৪ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর মুক্ত জলাশয়, যেমন- নদী, হাওর, বিল, খালে প্রায় ২৫০ প্রজাতির মাছ বাস করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর বিভিন্ন পরিবর্তনের ফলে মৎস্য উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে পানি গরম হয়ে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে মাছের পোনা উৎপাদন অনেকাংশে হ্রাস পায়। এর ফলে মৎস্য খাত থেকে আয় কমে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে মৎস্যজীবীদের ওপর, যাদের জীবিকা মূলত মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল।
কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবঃ
জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তন এবং আবহাওয়ার ঘটনাগুলি আরও ঘন ঘন এবং তীব্র হয়ে উঠছে, কৃষি খাত অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে যা খাদ্য নিরাপত্তা এবং লক্ষ লক্ষ কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং ফসলের ফলনঃ
কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে সরাসরি প্রভাবগুলির মধ্যে একটি হল ফসলের ফলনের উপর তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব। অনেক ফসলের সর্বোত্তম বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতার জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রার সীমা রয়েছে। তাপমাত্রা এই রেঞ্জগুলি অতিক্রম করার সাথে সাথে ফসলের ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় দেখা গেছে যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রায় প্রতি 1 ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির জন্য, গমের ফলন প্রায় 6% হ্রাস পেতে পারে।
পানির অভাব ও খরাঃ
জলবায়ু পরিবর্তন বৃষ্টিপাতের ধরণকে পরিবর্তন করে, যা অনেক অঞ্চলে আরও ঘন ঘন এবং গুরুতর খরার দিকে পরিচালিত করে। খরা পরিস্থিতি ফসলের উৎপাদনকে ধ্বংস করতে পারে, কারণ উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন হয়। তদুপরি, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাষ্পীভবনের হার বৃদ্ধি পায়, জলের ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে দেয় এবং কৃষি জলের সম্পদকে আরও স্ট্রেন করে।
চরম আবহাওয়া ঘটনাঃ
জলবায়ু পরিবর্তন চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতাও বৃদ্ধি করছে, যেমন ভারী বৃষ্টিপাত, বন্যা, তাপপ্রবাহ এবং ঝড়। এই ঘটনাগুলি ফসল, পশুসম্পদ এবং কৃষি অবকাঠামোর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে পারে। বন্যা উর্বর উপরের মাটি ধুয়ে ফেলতে পারে, অন্যদিকে তাপপ্রবাহ এবং ঝড় সরাসরি ফসলের ক্ষতি করতে পারে এবং কৃষি কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে।
কীটপতঙ্গ এবং রোগের প্রাদুর্ভাবঃ
পরিবর্তিত জলবায়ু কীটপতঙ্গ ও রোগের বিতরণ ও বিস্তারকেও প্রভাবিত করছে যা কৃষি উৎপাদনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে কিছু কীটপতঙ্গ এবং রোগজীবাণু তাদের ভৌগোলিক পরিসর প্রসারিত করতে পারে, নতুন অঞ্চলগুলিকে সম্ভাব্য সংক্রমণ এবং প্রাদুর্ভাবের জন্য উন্মুক্ত করে। এতে ফসলের ক্ষতি, কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং কৃষকদের অতিরিক্ত খরচ হতে পারে।
পশুসম্পদ উৎপাদন চ্যালেঞ্জঃ
জলবায়ু পরিবর্তনও গবাদি পশু উৎপাদনে ঝুঁকি তৈরি করে। তাপের চাপ দুগ্ধজাত গবাদি পশুর উত্পাদনশীলতা, উর্বরতা এবং দুধের ফলন হ্রাস করতে পারে, অন্যদিকে খরা গবাদি পশুর জন্য খাদ্য এবং জলের সম্পদের প্রাপ্যতা সীমিত করতে পারে। উপরন্তু, ভেক্টর-বাহিত রোগের বিতরণে পরিবর্তনগুলি পশুসম্পদ জনসংখ্যার স্বাস্থ্য এবং উত্পাদনশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবঃ
কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিণতি বয়ে আনছে। শস্যের ফলন এবং গবাদি পশুর উৎপাদনশীলতা হ্রাসের ফলে খাদ্যের দাম উচ্চতর হতে পারে, খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে এবং দারিদ্র্য ও অপুষ্টিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে যেখানে কৃষি অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয়ের একটি প্রাথমিক উৎস।
অভিযোজন এবং প্রশমন কৌশলঃ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষি খাতকে অবশ্যই অভিযোজন এবং প্রশমন কৌশল উভয়ই গ্রহণ করতে হবে। অভিযোজন ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে খরা-প্রতিরোধী এবং তাপ-সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন, পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির উন্নতি, কৃষি বনায়ন এবং সংরক্ষণ কৃষি কৌশল বাস্তবায়ন এবং কীটপতঙ্গ ও রোগের জন্য প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। প্রশমন কৌশলগুলি কৃষি কার্যক্রম থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার উপর ফোকাস করে। এর মধ্যে টেকসই কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করা, যেমন নির্ভুল কৃষি, দক্ষ সার ব্যবস্থাপনা, এবং মিথেন নির্গমন কমাতে পশুসম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নতি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। উপরন্তু, টেকসই ভূমি-ব্যবহারের অনুশীলনের প্রচার, যেমন বন উজাড় রোধ করা এবং ক্ষয়প্রাপ্ত জমি পুনরুদ্ধার করা, কার্বন বিচ্ছিন্ন করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করতে সহায়তা করতে পারে।
সহযোগিতা এবং নীতি সমর্থনঃ
কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সরকার, নীতিনির্ধারক, গবেষক, কৃষক এবং বেসরকারি খাতের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। জলবায়ু-সহনশীল কৃষি পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করা, টেকসই খাদ্য ব্যবস্থার প্রচার, এবং সম্পদ, প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকদের সহায়তা করা একটি পরিবর্তনশীল জলবায়ুর মুখে খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
কৃষি খাত বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে খাওয়ানোর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলির জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলির মধ্যে একটি। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, জলের ঘাটতি, চরম আবহাওয়ার ঘটনা এবং কীটপতঙ্গ ও রোগের প্রাদুর্ভাব ফসলের ফলন, গবাদি পশুর উৎপাদনশীলতা এবং লক্ষ লক্ষ কৃষকের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই চ্যালেঞ্জগুলির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং কৃষি কার্যক্রম থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করা খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি খাতের দীর্ঘমেয়াদী টেকসইতা নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।