জলবায়ু পরিবর্তন কিভাবে লবণাক্ততা বাড়াচ্ছে?
জার্মান ওয়াচের তথ্যমতে, জলবায়ু বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম। বিপর্যয়ের যে কয়টি কারণ আছে তার মধ্যে লবণাক্ততা অন্যতম। লবণাক্ততা বলতে বোঝায় মাটি বা পানিতে লবণের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যাওয়া। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা পরিলক্ষিত হওয়া একটি সাধারণ ব্যাপার। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
৪১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার আয়তন ২৮,৬০০ বর্গকিলোমিটার, যা দেশের প্রায় ২০ ভাগ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র বিজয়ের পর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার দৈর্ঘ্য বেড়ে ৭১০ কিলোমিটার হয়েছে, যা দেশের প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি। এই এলাকায় কৃষকরা বর্ষাকালে প্রধানত স্থানীয় উন্নত জাতের ধানের চাষ করে থাকেন। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে জমি ব্যবহার করা হয় না কারণ পানি খুব লবণাক্ত হয়ে যায় এবং সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি থাকে না। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে এবং এর ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ ও খামারের জন্য সমস্যা হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকাগুলোতে দূষণ ও ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের আবাদি জমির শতকরা ১০ ভাগের বেশি দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকায়। এ দেশের উপকূলবর্তী এলাকার ২৮.৬০ লাখ হেক্টরের মধ্যে ১০.৫৬ লাখ হেক্টর আবাদি জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলার অধিকাংশ জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় আক্রান্ত। ১৯৭৩ সালে উপকূলীয় এলাকার ৮ লক্ষ ৩৩ হাজার হেক্টর, ২০০০ সালে ১০ লক্ষ ২০ হাজার হেক্টর এবং ২০০৯ সালে ১০ লক্ষ ৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে লবণাক্ততা লক্ষ করা যায়। জমিতে লবণাক্ততার কারণে এ এলাকায় বর্ষাকালে শুধু আমন ধানের উৎপাদন ছাড়া সারা বছর পতিত থাকে, কারণ এলাকায় জমিতে জোয়ার আসে ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে। শুষ্ক মৌসুমে মিষ্টি পানির অভাবের কারণে বোরো ধান আবাদ করা সম্ভব হয় না।
লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেতে পারে বিভিন্ন কারণে। বাংলাদেশে বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায় দু’টি প্রাকৃতিক কারণে।
১- জোয়ারের সময় লবণযুক্ত পানি জমিতে প্লাবিত হয়ে;
২- ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি কৈশিক রন্ধ্র দিয়ে মাটির উপরে চলে আসলে।
সাধারণত শুকনো মৌসুমে (মার্চ-মে) লবণাক্ত জোয়ারের পানিতে বহু জমি তলিয়ে যায়। তখন লবণাক্ত পানি জমিতে ছড়িয়ে যায়। এ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা হলে মাটি বা জমি লবণাক্ত হয়। অন্যদিকে বর্ষা শেষ হলে জানুয়ারি – ফেব্রুয়ারি মাস হতে মাটি শুকাতে শুরু করে। এর ফলে মাটিতে অনেক ফাটল সৃষ্টি হয়।যখন মাটির উপরে রোদ পড়ে তখন মাটির উপরিস্তর হতে পানি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে চলে যায়। যার ফলে ভূগর্ভ থেকে লবণাক্ত পানি ভূপৃষ্ঠে আসতে পারে। এ ছাড়া মনুষ্য সৃষ্ট কারণেও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। যেমন, উপকূলীয় অনেক এলাকায় মৎস্য চাষিরা লবণ পানির ঘের তৈরি করে চিংড়ি চাষ করে। এতে করে ঐসব ঘেরের মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়।
বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর আবহাওয়া চরম-ভাবাপন্ন হয়ে যাবে।
গত কয়েক বছরের সংবাদমাধ্যমের খবর দেখলে অনেকেরই মনে হবে: সেই দিন হয়তো এসে গেছে।
পৃথিবীর কোথাও এখন অস্বাভাবিক গরম পড়ছে, কোথাও অস্বাভাবিক ঠান্ডা পড়ছে, কোথাও বন্যা, কোথাও বছরের পর বছর ধরে খরা হচ্ছে, কোথাও আবার ঘন ঘন দাবানল সৃষ্টি হচ্ছে। নিয়মিত সংবাদ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে এসব খবর।
ড. সালিমুল হক বলছেন, গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন যে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এগুলো হচ্ছে।বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলছে, প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ২০১৮ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় এক ডিগ্রি বেশি। ২০১৫ থেকে প্রতি বছরই পৃথিবীর উষ্ণতম বছরের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ফসলের প্যাটার্ন বদলে যাচ্ছে – বলছেন কৃষকরা
ড. সালিমুল হক বলছেন, আবহাওয়ায় যে চরম প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই ঘটছে।
বিজ্ঞানীদের মতে এভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি বেড়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্ত:সরকার প্যানেল আইপিসিসি বলছে, এখনই যদি পৃথিবীর দেশগুলো এ নিযে কার্যকর উদ্যোগ না নেয় – তাহলে পৃথিবীতে দূর্যোগ নেমে আসবে, সমুদ্রে পানির স্তর বেড়ে যাবে, সমুদ্রে পানির তাপমাত্রা এবং অম্লতা বেড়ে যাবে, ধান-গম-ভুট্টার মতো ফসল ফলানোর ক্ষমতা বিপন্ন হয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন এমনভাবে বাড়ছে যে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছিল তাতে আর কাজ হচ্ছে না।
সবশেষে বলা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের লবণাক্ত কবলিত জমির লবণাক্ততা কমাতে হলে লবণ পানির ব্যবহার কমাতে হবে। পোল্ডার ব্যবস্থাপনাসহ সুইসগেট ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। লবণাক্ততা সহিষ্ণু বিভিন্ন জাতের ফসল চাষ করতে হবে। সর্বোপরি মাটি ও পানির লবণাক্ততা বিষয়ে সকলকে সচেতন থাকতে হবে।
তথ্যসূত্র-বিবিসি, বাংলা ট্রিবিউন, কৃষি মন্ত্রণালয়
Writer: Autin Saha