সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হ্রাসে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর সমপ্রবাহে গঠিত সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন, যা অসংখ্য নদী, খাল, মোহনা এবং খাড়ির সুনিপুন জাল দ্বারা বেষ্টিত। প্রায় ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই বনাঞ্চলের ৬৫১৭ কি.মি. জায়গা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত এবং বাকি প্রায় ৩৪৮৩ কি.মি. অঞ্চল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। সুন্দরবন একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান যা তার অনন্য জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশগত তাৎপর্যের জন্য বিখ্যাত। ২৫০টিরও বেশি পাখির প্রজাতি, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, শুশুক, মোহনা কুমির, ডোরাকাটা হরিণ, বন্য শুকোর, অসংখ্য সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণীসহ অজস্র বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল এই সুন্দরবন। সুন্দরী (Heritiera fomes), গেওয়া (Excoecaria agallocha) এবং কেওরা (Sonneratia apetala) প্রজাতির গাছ সুন্দবনে আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে, যা এর স্বতন্ত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পরিবেশগত সমৃদ্ধিতে অবদান রাখে। (Pletcher, 2024, Gopal and Chauhan, 2006, Gaworecki, 2017)
জলবায়ু পরিবর্তন সুন্দরবনের ওপর উল্লেখযোগ্য বিরূপ প্রভাব ফেলে, যা এর বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্রকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, কড়ের মাত্রাবৃদ্ধি এবং পানির লবণাক্তকরণ বৃদ্ধি হল সুন্দরবনের জীববৈচিত্রকে হুমকির মুখে ফেলার মূল কারণ। (Dasgupta, 2021)
কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন সুদরবন-কে প্রভাবিত করছে?
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বহুমুখী হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে খাদ্য শৃঙ্খলের ব্যাঘাত, বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির সংখ্যা হ্রাস, চরম আবহাওয়ার প্রতিকূলতা বৃদ্ধি, ম্যানগ্রোভের অন্তর্নিহিত গঠনের পরিবর্তন এবং প্রাণীকুলের বাসস্থানের ক্ষতি। এই প্রভাবগুলি ম্যানগ্রোভ জীববৈচিত্রের সূক্ষ্ম পরিবেশগত ভারসাম্যকে ক্রমাগত ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
সুন্দরবন একটি নিচু উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় এটি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ত পানি অনুপ্রবেশের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এটি ম্যানগ্রোভ বনকে হুমকির মুখে ফেলছে, কারণ ম্যানগ্রোভের মিঠা পানি লভ্যতার জন্য স্থলমুখী স্থানান্তর ক্রমাগত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বাঁধের মতো মানুষের অবকাঠামো দ্বারা। লবণাক্ততা বৃদ্ধি মিঠা পানির ম্যানগ্রোভ হ্রাস এবং লবনাক্ততা-সহনশীল প্রজাতির বৃদ্ধির মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গঠন পরিবর্তন করছে। যার ফলে সম্পূর্ন ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্র এবং এর কার্যপদ্ধতির ব্যাঘাত ও পরিবর্তন ঘটছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনে মিঠাপানির প্রাপ্যতা হ্রাস পাচ্ছে। যা ফলস্বরূপ সুন্দরবনের খাদ্য শৃঙ্খল এবং পরিবেশগত ভারসাম্যকে ব্যাহত করছে। এটি তৃণভোজী জনসংখ্যার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, যা বাঘের মতো প্রথম শ্রেণীর মাংসাশী সকল প্রাণীর জীবনকে প্রভাবিত করবে যারা বেঁচে থাকার জন্য তৃণভোজী প্রাণীর উপর নির্ভর করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে ক্রমাগত তামমাত্রা বাড়ছে, যার সরাসরি শিকার হচ্ছে সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল। বিভিন্ন উদ্ভিদের অঙ্কুরোদগমের সময় পরিবর্তন, যথাসময়ে বৃষ্টির অভাব, অনাবৃষ্টি, খরার উদ্ভব শুধুমাত্র উদ্ভিদের বেচে থাকাকেই চ্যালেঞ্জ করছেনা, একইসাথে অন্তরায় হয়ে দাড়াচ্ছে উদ্ভিদের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা পক্ষীকূল এবং অন্যান্য জীবদেরকেও। চরম তাপমাত্রায় হাসফাস করছে জীববৈচিত্র, যার প্রভাব আরো বেশি ত্বরান্বিত করছে অতিরিক্ত লবনাক্ততা। চিরায়ত বৃষ্টির মৌসুমের সময়কালের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, যা পানিচক্র থেকে শুরু করে নদী, মোহনা এবং সমুদ্রের মাছের ডিম পাড়ার সময় চক্রকে পরিবর্তন করছে। যথাসময়ে বৃষ্টি না হওয়া, অনাবৃষ্টি, পানির লবনাক্ততা এবং গড় তাপমাত্রার পরিবর্তন শুধু উদ্ভিদের জীবনচক্রকেই প্রভাবিত করেনা, নির্ধারন করে মাছের ডিম পাড়া এবং পোনা প্রসবের সময়কেও।
সুন্দরবন অঞ্চলে আরও ঘন ঘন এবং তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা ঘটছে যা জলবায়ু পরিবর্তনের একটি নিদর্শন, এবং এর ফলে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে মাইলের পর মাইল ম্যানগ্রোভ। এখানে বসবাসরত বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ক্রমাগত ধ্বংসের মুখে পড়ছে, যা ফলস্রুতিতে প্রভাব ফেলছে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার উপর। সুন্দরবনের বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদকূল জলবায়ু পরিবর্তন-প্ররোচিত প্রভাব যেমন বাসস্থানের ক্ষতি, শিকারের প্রাপ্যতার অভাব এবং মানব-বন্যপ্রাণী সংঘাত বৃদ্ধি; এসকল কারনে প্রতিকুল অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে, যার কারনে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। (Kanksha & Vikas, 2012, Ahuja, 2022, Noor Mohammad Sarker, 2013)
জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবগুলি কমানোর জন্য একটি সমন্বিত বাস্তুতন্ত্র ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রয়োজন, যা জীববৈচিত্র ক্ষতির কারনগুলি মূল থেকে চিহ্নিত করে মোকাবেলা করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় জোরদার করা, যুগোপযোগী জ্ঞান ও গবেষণা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সংরক্ষণ য় জীবিকার চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখে এমন টেকসই পরকল্পনা অনুশীলন, প্রচার ও বাস্তবায়ন হবে এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য। আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দরবনের অনন্য জীববৈচিত্র্য রক্ষার নিমিত্তে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লিখেছেন – আসিফ আদনান
References
Noor Mohammad Sarker, S. Y. (2013). Global Climate Change and the Biodiversity of the Sundarbans. Journal of International Relations.
Pletcher, K. (2024, April 18). Sundarbans Mangrove Forest, Wildlife Reserve, India-Bangladesh Border. Encyclopedia Britannica.
Gopal, B., & Chauhan, M. (2006). Biodiversity and its conservation in the Sundarban Mangrove Ecosystem. Aquatic https://doi.org/10.1007/s00027-006-0868-8 Sciences. 68(3), 338-354.
Gaworecki, M. (2017, October 8). Biodiversity of Indian Sunderbans recorded in one compendium for time. News for first time. Mongabay Environmental
https://news.mongabay.com/2017/10/biodiversity-of-indian-sunderbans-recorded-for- the-first-time/
Dasgupta, S. W. D. J. S. M. 1. E. A. (2021, January 5). Coping with climate change in the Sundarbans: Lessons from multidisciplinary studies. Prevention Web. lessons-multidisciplinary-studies
Good .