নবায়নযোগ্য শক্তি
নবায়নযোগ্য শক্তি কি?
নবায়নযোগ্য শক্তি বা রিনিউয়েবল এনার্জি হলো এমন এক ধরনের শক্তি যা খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই পুনরায় ব্যবহার করা যায় এবং বারবার ব্যবহারের ফলেও এরুপ শক্তির উৎসগুলো নিঃশেষ হয়ে যায় না।এই শক্তিগুলো এমন উৎস থেকে আসে যা ক্রমাগত এবং প্রাকৃতিকভাবেই নবায়ন হয়ে থাকে। যেমন: বায়ু শক্তি, সৌর শক্তি ,ভূ-তাপীয় শক্তি ইত্যাদি।
অনবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলি জীবাশ্ম জ্বালানি জাতীয়, যেমন: কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল এগুলো সীমাবদ্ধ শক্তির উৎস।কিন্তু বায়ুপ্রবাহ ও সৌরশক্তি,পানি অফুরন্ত,ফলে নবায়নযোগ্য শক্তি যা শেষ হয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তির বড় সুবিধা হলো এটি পরিবেশবান্ধব এবং কার্বন নিঃসরণমুক্ত অর্থাৎ এরা বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়ায় না।তাই এটি বায়ু-পানিসহ পরিবেশের কোনো উপাদানকেই দূষিত করে না।
নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস:
বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস যেমন,সূর্যের আলো ও তাপ,সৌর শক্তি,বায়ু প্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈব শক্তি, ভূ-তাপীয় শক্তি, সমুদ্র তরঙ্গ, জোয়ার-ভাটা, শহুরে আবর্জনা,হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ইত্যাদি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস।বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল (বিইপিআরসি) এর তথ্যমতে প্রতিদিন পৃথিবীতে এক ঘণ্টায় যে পরিমাণ সৌরশক্তি পৌঁছায় তা দিয়ে পুরো পৃথিবীর দুই বছরের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো যাবে।
নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার:
- সোলার প্যানেল: সূর্যালোক আমাদের সহজলভ্য শক্তি সম্পদগুলির মধ্যে প্রথম অবস্থানে রয়েছে।সূর্য থেকে আলোক এবং তাপ শক্তি সংগ্রহ করে সূর্যের আলোকে কাজে লাগাতে পারি।সূর্যালোক থেকেই সোলার প্যানেল তৈরি করা যায়, যার কাজ হল সূর্যের আলোক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা।
- বায়ুকল: বায়ু শক্তিকে সাধারণত টারবাইনের মাধ্যমে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে বিদ্যুৎ শক্তি পাওয়া যায়।
- বায়োমাস : মানুষ অথবা গৃহপালিত পশু-পাখির বিষ্ঠা ,কাঠ ও কাঠের বর্জ্য এবং পচনশীল আবর্জনা থেকে বায়োগ্যাস তৈরি করা যায়। যা রান্নার কাজে বা বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগে।গাঁজন প্রক্রিয়ায় শর্করা থেকে সরাসরি হাইড্রকার্বন প্রস্তুত করা যায় যা যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
- জলবিদ্যুৎ: নবায়নযোগ্য শক্তির সব থেকে পরিচিত মাধ্যমটি হলো জলবিদ্যুৎ। বাঁধ বা নদী-প্রবাহ ব্যবস্থা ব্যবহার করে জোয়ার ভাটার প্রবাহিত পানির শক্তিকে রূপান্তর করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। কাপ্তাই বাংলাদেশের বৃহত্তম বাঁধ ও একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ।
- হাইড্রোজেন ফিউশন নিউক্লিয়ার পাওয়ার : হাইড্রোজেন ফিউশন নিউক্লিয়ারের জ্বালানি হাইড্রোজেন পানি থেকে সহজেই সংগ্রহ করা যায় । বিশ্বে হাইড্রোজেন মৌলের পরিমাণ প্রায় ৭৫%, যা নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য অনেক।
- ভূ-তাপীয় শক্তি : ভূ তাপীয় শক্তি থেকেও নবায়নযোগ্য শক্তি পাওয়া যায়।
নবায়নযোগ্য শক্তি কেনো প্রয়োজন?
পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ সীমিত তাও আবার খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে কয়লার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি যা একটি জৈব পদার্থ। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে জীবাশ্ম জ্বালানি চাহিদা অনুযায়ী মেটানো খুব একটা সহজ নয়। এছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাস প্রচলিত একটি শক্তির উৎস ,যা ভূগর্ভে পাওয়া যায়। এর প্রধান উপাদান মিথেন যার পরিমাণ ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ এবং এটি একটি গ্রিনহাউস গ্যাস। যার ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রতিনিয়ত ব্যবহারের ফলে এসব কয়লা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ দিন দিন কমে আসছে। তাই বিকল্প শক্তি হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তি বিশ্বজুড়ে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাছাড়া সৌর শক্তি হল নবায়নযোগ্য শক্তির দ্রুততম ক্রমবর্ধমান উৎস। একই সাথে এই সকল প্রযুক্তি সংক্রান্ত খরচও কমে এসেছে আশানুরূপ পরিমাণে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নবায়নযোগ্য শক্তির প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জ্বালানি বিভাগের তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে যে বড় কোনো নতুন প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হলে ও বর্তমান হারে ব্যবহার অব্যাহত থাকলে ২০২৫-২০৩১ এর মধ্যেই আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে যাবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তার মোট দেশজ উৎপাদনের ৭ শতাংশ হারাতে পারে পানির নিচে।
নবায়নযোগ্য শক্তির উপকারিতা ও যথাযোগ্যতা
নবায়নযোগ্য শক্তি জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করতে বায়ু দূষণ কমাতে সাহায্য করে। কারণ এটি গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন করে না। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করতে ও বায়ু দূষণ কমাতেও সাহায্য করে।
জীবাশ্ম জ্বালানি পরিবেশ ও মানব স্বাস্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন পৃথিবীতে কার্বন ডাই অক্সাইডার ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল ডুবে যাবার উপক্রম হচ্ছে। তাই প্রচলিত জ্বালানি শক্তির বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা খুব জরুরী।
জাতিসংঘের দেওয়া তথ্যমতে বর্তমানে প্রায় ২৯ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। সারা পৃথিবীতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে।নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনার বিচারে বাংলাদেশের স্থান ৪১তম। তবে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। বায়োগ্যাস, বায়োমাস, বর্জ্য থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জ্বালানি গ্যাস ও বিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে। বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ-এর একটি হচ্ছে সৌর বিদ্যুৎ, যেটি জলবায়ু পরিবর্তন রোধে একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। সারা পৃথিবীতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। ধারণা করা হয়, বায়োমাস থেকে বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ মেটানো হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে তার পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। এছাড়া বর্তমানে চীন বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে এগিয়ে আছে।
জনসচেতনতা ও করণীয়
বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো তাদের প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রচুর কার্বন-নিঃসরণ করলেও, বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র দেশ গুলো এর ক্ষতিকর দিকগুলোর সম্মুখীন হয়। তাই বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ফসিল ফুয়েল থেকে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারে প্রতি যত এগিয়ে আসবে ততই পরিবেশের ক্ষতিসাধন কম হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং একটি টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থায় পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী আন্দোলন সমূহ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার উৎসাহ অব্যাহত রেখেছে। আমাদেরও উচিত ফসিল ফুয়েল এর ব্যবহার বন্ধ করে রিনিউয়েবল এনার্জিতে (নবায়নযোগ্য শক্তি) সুইচ করা। ২০২৪ এ দুবাইয়ে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ নেতৃত্বাধীন COP28 শীর্ষ সম্মেলনে সর্বশেষ খসড়াতে ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষমতা তিনগুণ করার প্রতিশ্রুতির উল্লেখ রয়েছে, যার অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করেছে ১০০টি দেশ এবং প্রায় ২০০টি দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে আসার বিষয়ে রাজি হয়েছে।
তাই সবাইকে নবায়নযোগ্য শক্তির সুবিধা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করা,এর ব্যবহারে উৎসাহিত করে তোলা এবং যথাযথ জ্ঞান প্রদান করা আমাদের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব। এতে অগ্রিম খরচ হতে পারে ঠিকই কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয় এবং পরিবেশগত সুবিধা সুনিশ্চিত। তাই
“ফুয়েল বন্ধ কর ,নবায়নযোগ্য শক্তি আনো ” এটাই যেন হয় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রতিপাদ্য।