জলবায়ু পরিবর্তন কী?

“জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ”

,এ বিষয়টির সাথে কম বেশি আমরা সবাই পরিচিত।জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সংকট যা গোটা মানবজাতির অস্তিত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে। 

চলুন এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানা যাক।

প্রথমে জানি জলবায়ু এবং জলবায়ু পরিবর্তন কি?

কোনও একটি জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার যে গড়-পড়তা ধরন, তাকেই বলা হয় জলবায়ু। আবহাওয়ার সেই ধরন বদলে যাওয়াই হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন।

জলবায়ু পরিবর্তনের পিছনে প্রাকৃতিক কারণ যেমন রয়েছে,তেমন মানুষও এর পিছনে দায়ী।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান প্রাকৃতিক কারণগুলি হলো:

•সৌর বিকিরণ: সূর্যের বিকিরণ শক্তির পরিবর্তন পৃথিবীর তাপমাত্রায় প্রভাব ফেলে। সানস্পট ও সোলার ফ্লেয়ারের মতো সৌর কার্যকলাপ জলবায়ু পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

•আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত: আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বায়ুমণ্ডলে বিশাল পরিমাণে গ্যাস ও ছাই নির্গত করে, যা সূর্যের আলোকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমায়।

•পৃথিবীর কক্ষপথের পরিবর্তন: পৃথিবীর কক্ষপথের আকার, ধ্রুবকের ঢাল এবং কক্ষপথের পূর্বাবর্তন সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। এটিও কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে।

•মহাসাগরীয় স্রোত: মহাসাগরের স্রোত, যেমন এল নিনো ও লা নিনা, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের ধরণ এ বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটায়।

 •গ্রিনহাউস প্রভাব: প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ পরিবর্তন পৃথিবীর তাপমাত্রা পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে।

এবার দেখা যাক মানুষ কিভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী

১. জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার : তেল, কয়লা, এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) নির্গত হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন, এবং কলকারখানা থেকে নির্গত এই গ্যাস গুলো গ্রিনহাউস প্রভাব বৃদ্ধি করে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ায়।

২. বনভূমি ধ্বংস : গাছ-পালা কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে সক্ষম। বনভূমি ধ্বংসের ফলে বায়ুমণ্ডলে CO₂ এর ঘনত্ব বেড়ে যায়, যা গ্রিনহাউস প্রভাব বাড়িয়ে দেয় এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে।

৩. শিল্প কার্যক্রম : কলকারখানা এবং বিভিন্ন শিল্প স্থাপনা থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন (CH₄) এবং নাইট্রাস অক্সাইড (N₂O) এর মত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে। এই গ্যাসগুলি বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।

৪. কৃষি কার্যক্রম : গবাদি পশু পালন ও ধান চাষ থেকে মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। নাইট্রোজেন সার ব্যবহারের ফলে নাইট্রাস অক্সাইড নির্গত হয়। এই গ্যাসগুলো গ্রিনহাউস প্রভাব বৃদ্ধি করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে।

৫. নগরায়ন : ব্যাপক নগরায়ন করার কারণে বনভূমি ও গাছপালা উজাড় করা হচ্ছে। তাছাড়া ব্যবহারযোগ্য ভূমি ভবন নির্মাণে ব্যবহার হচ্ছে। একারণে ও গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা বাড়ছে।

৬. বর্জ্য অব্যবস্থাপনা : অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে মিথেন গ্যাস নির্গত হয়, যা শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। বর্জ্যের পচন প্রক্রিয়া থেকে নির্গত এই গ্যাস পরিবেশ দূষণ বাড়ায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গুলো আসলে কি তা জানা যাক:

• তাপমাত্রা বৃদ্ধি : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গ্রীষ্মকালে তীব্র তাপদাহের ঘটনা বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

• সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি : বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে মেরু ও গ্লেসিয়ার বরফ গলে যাচ্ছে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বন্যার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে এবং অনেক দ্বীপ ও উপকূলবর্তী এলাকা বিলুপ্তির হুমকির মুখে পড়ছে।

 •আবহাওয়ার ঘনঘন পরিবর্তন : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার ঘনঘন পরিবর্তনের ঘটনা বাড়ছে, যেমন তীব্র ঝড়, বন্যা, খরা, এবং তুষারঝড়। এই চরম আবহাওয়া কৃষি, অবকাঠামো এবং মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

• জলের প্রাপ্যতা হ্রাস : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক অঞ্চলে জলের প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে। খরা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষি এবং পানীয় জলের সংকট বাড়ছে

• জীববৈচিত্র্যের হ্রাস : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে এবং অনেক প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলুপ্তির পথে রয়েছে। সমুদ্রের উষ্ণতা এবং অম্লীকরণের কারণে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে।

• কৃষি পণ্য উৎপাদন : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন ফসলের  উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে, যা খাদ্য সংকট সৃষ্টি করছে।

• স্বাস্থ্য সমস্যা : তাপদাহ, বন্যা, এবং আবহাওয়ার ঘনঘন পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিটস্ট্রোক, পানিবাহিত রোগ, এবং ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর মতো রোগের প্রকোপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সবাইকে সম্মিলিত উদ্যোগে কাজ করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি যেমন যেমন সৌর ও বায়ু শক্তির ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বনভূমি ধ্বংস বন্ধ করে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করতে হবে, যাতে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। টেকসই কৃষি পদ্ধতি, যেমন জৈব কৃষি ও সংরক্ষণমূলক কৃষির মাধ্যমে নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমন কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদ্যুৎ ব্যবহারে দক্ষতা বাড়াতে হবে। কঠিন বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মিথেন গ্যাসের নির্গমন কমাতে হবে। গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি, বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং সাইক্লিং ও হাঁটার মতো পরিবেশবান্ধব পরিবহন পদ্ধতি প্রচলন করতে হবে। আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে।সর্বোপরি, জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, এবং সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রচারাভিযান চালাতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে আমরা পরিবেশ রক্ষা করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী নিশ্চিত করতে পারব।

শেয়ার করুন..
1 1 vote
Article Rating
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments